ইব্রাহীম মিঞা, বিরামপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি :পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি এই তিনটিই যেন তরুণ উদ্যোক্তা মোঃ আবু তারেকের সফলতার মূলমন্ত্র। দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী থানার পশ্চিম জানিপুর গ্রামের ৩০ বছর বয়সী এই যুবক একসময় ছিলেন চাকরিপ্রত্যাশী। কিন্তু চাকরির অনিশ্চয়তা আর অপ্রাপ্তি তাঁকে ভিন্ন পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। এখন তিনি নিজেই তৈরি করেছেন কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র, লিখেছেন সফলতার অনন্য দৃষ্টান্ত।
বন্ধু আবু হেনাকে সঙ্গে নিয়ে ২০২৫ সালের শুরুতে তিনি ভাড়া নেন বিরামপুর পৌর শহরের মির্জাপুর এলাকায় ৩২ শতক জমি। সেই জমিতেই গড়ে তোলেন হাঁসের খামার। শুরুতেই মূলধন দাঁড়ায় ৮ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে আশ্রয় এনজিওর সহায়তা দেড় লক্ষ, বিসমিল্লাহ ফিডের প্রোপাইটার আরিফুর রহমানের সহযোগিতা ছয় লক্ষ এবং পরিবারের সমর্থন দেড় লক্ষ টাকা। এই অর্থে আনেন ২০ হাজার খাঁকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁসের বাচ্চা।
খামার শুরু করা মানেই শুধু বিনিয়োগ নয়, প্রতিদিনের নিরলস শ্রমও জরুরি। প্রতিদিন প্রায় ২৫০ কেজি খাবার লাগে হাঁসগুলোর জন্য, যার খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার টাকা। নিয়মিত ওষুধ ও ক্যালসিয়ামের ব্যবস্থাও রাখতে হয়। খামারের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন স্থানীয় দুই কর্মী সুশান্ত মুর্মু ও মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৪)।
আবু তারেকের খামারজীবন যেন দিন-রাতের অবিরাম সংগ্রামের গল্প। সন্ধ্যার পর থেকেই তিনি খামারে অবস্থান করেন টানা ভোর পর্যন্ত। নিজ হাতে হাঁসের খাবার তৈরি করেন, নির্দিষ্ট সময়ে শেড থেকে হাঁসগুলো বের করে খোলা জায়গায় খাবার খাওয়ান। ক্যালসিয়াম মিশ্রিত পানি পান করিয়ে আবার ছাড়েন পুকুরে। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কর্মচারীরা খামার দেখাশোনা করলেও, ডিম সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিজেই তদারকি করেন তিনি।
আজ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫। খামারের হাঁসগুলোর বয়স ১৫৭ দিন। বর্তমানে ১,৫০০ হাঁসের মধ্যে প্রায় ৭০০টি নিয়মিত ডিম দিচ্ছে। খুব শিগগিরই দিনে ১,৩০০ হাঁস ডিম দেবে বলে আশাবাদী তারেক। পাইকারি বাজারে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকায়। অনেক সময় ব্যবসায়ীরাই সরাসরি খামার থেকে ডিম কিনে নিয়ে যান।
তারেক হিসাব কষে দেখেছেন, এই হাঁসগুলো অন্তত ১৮ মাস পর্যন্ত লালন-পালন করা যাবে। খামার থেকে ঋণ শোধ করার পাশাপাশি এ বছর অন্তত ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
আবু তারেকের সাফল্যে সবচেয়ে খুশি তাঁর পরিবার। তাঁর বাবা মোখলেছুর রহমান জানান, ছোটবেলা থেকেই তারেক খুব পরিশ্রমী ছিল। একসময় আমরা চিন্তিত ছিলাম তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখন সে শুধু নিজের নয়, আমাদের সবার গর্ব।
স্থানীয় যুবক রেজোয়ান কবির বলেন, আমরা দেখেছি তারেক ভাই কত কষ্ট করে খামার গড়েছে। তাঁর খামার দেখে আমাদেরও উৎসাহ হয় চাকরির পেছনে না ছুটে আমরাও কিছু করতে পারব।
আবু তারেকের খামার শুধু তাঁর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাই বদলাচ্ছে না, আশেপাশের মানুষের জন্যও তৈরি করেছে নতুন সুযোগ। খামারের কারণে স্থানীয় দু’জন স্থায়ীভাবে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া হাঁসের খাবার সরবরাহ, ডিম বিক্রি ও পরিবহন সব মিলিয়ে অনেকেরই বাড়তি আয়ের পথ খুলেছে।
বিরামপুর পৌর এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল খালেক বলেন, তারেকের খামার থেকে প্রতিদিন আমরা ডিম পাই। এতে বাজারে সরবরাহও বাড়ছে, দামও স্থিতিশীল থাকছে।
আবু তারেকের জীবনের পথচলা সহজ ছিল না। ২০১১ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন এবং ২০১৮ সালে বিরামপুর সরকারি কলেজ থেকে বিএ অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর কাজ করেছেন বিভিন্ন খামারে, অর্জন করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতা। একসময় নিউলাইট যুব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। আবার চাকরির আশায় ঘুরেছেন এসিআই পেস্টিসাইডসহ একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু কোথাও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, মেলেনি স্থিতিশীল জীবন।
অবশেষে নিজের অভিজ্ঞতা আর পরিশ্রমের উপর ভরসা করেই দাঁড় করালেন হাঁসের খামার। আজ তাঁর এই উদ্যোগ শুধু তাঁর পরিবারকেই স্বাবলম্বী করছে না, বরং আশেপাশের তরুণদেরও দিচ্ছে অনুপ্রেরণা চাকরির পেছনে ছুটে নয়, পরিশ্রম করে নিজেই গড়ে তোলা যায় ভাগ্যের নতুন দিগন্ত।