Sunday, November 5, 2023

হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের মাচাং ঘর

টিং শৈ গ্রু মংটিং : বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় যেন নানাভাবেই শিল্পী। তারা যেমন নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করেন, চাষাবাদেরও রয়েছে তাদের ভিন্ন পদ্ধতি।
বসবাসের জন্য তারা ব্যবহার করেন পাহাড়ের ঢালুতে ভিন্ন কায়দায় বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি মাচাং ঘর। 
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবানে সদর উপজেলা, রুমা, থানছি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়িসহ সাতটি উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেক পরিবারই তাদের বসবাসের জন্য মাচাং ঘর তৈরি করেন। বিশেষ করে দূর্গম এলাকায় জুম চাষাবাদ এবং বসবাসের জন্য মাচাং ঘরগুলো তৈরি হয়। সাধারণত বাঁশ, ছন দিয়ে নিপুণভাবে তৈরি হয় এসব মাচাং ঘর। তবে ঘরের বেশির ভাগ অংশেই বাঁশের ব্যবহার হয়ে থাকে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন চৌকস, তেমনি প্রাকৃতিক শীতাতপ হওয়ার কারণে এই মাচাং ঘরে বসতে ও ঘুমাতে খুবই আরামদায়ক।
তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং পাহাড় থেকে বাঁশ ও ছন হারিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে বাঁশের, ছনের তৈরি মাচাং ঘরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জুম পাহাড়ের শীর্ষে কিংবা ছোট বাগান বাড়িতে একসময় জমির মালিকরা মাচাং ঘর তৈরি করে সেখানে তাদের সময় ব্যয় করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে চাহিদার মতো বাঁশ, গাছ ও ছন না পাওয়ায় এখন পার্বত্য জেলাগুলো মাচাং ঘর হারিয়ে যাওয়ার পথে।
বান্দরবানের পরিবেশবিদ অং চা মং বলেন, পার্বত্য এলাকায় এক সময় মাচাং ঘরের যথেষ্ঠ কদর ছিল। যে কোনো পাহাড়ি বাগানে একটি মাচাং ঘর দেখতে পেতাম, কিন্তু বর্তমানে কিছু অসাধু বনখেকোদের কারণে পাহাড়ে এখন আর আগের মত ছন, বাঁশ, গাছ পাওয়া যায় না। কারণ বনখেকোরা বড় বড় গাছ কাটার কারণে পরিবেশ একদিকে দূষিত হচ্ছে অপরদিকে প্রয়োজনমতো ছন, বাঁশ ও গাছ না পাওয়ার কারণে পাহাড়ের ঐতিহ্য মাচাং ঘর তৈরিতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
তিনি আরো বলেন, ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘরকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি জানান, পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পাহাড়িরা পাহাড় কাটায় অভ্যস্ত ছিল না। পাহাড় কাটা রোধ করতেই তারা মাচাং ঘর বেঁধে থাকেন। পাহাড়ের মাটি সাধারণত ঢালু থাকে। মাচাং ঘর না বাঁধলে পাহাড়ি ঢালু মাটি সমতল করতে পাহাড় কাটতে হতো। মূলত এ কারণেই পাহাড়িরা মাচাংঘরে জীবন ধারণ করে থাকেন। আর এ থেকেই পাহাড়ি সমাজে এটি একটি সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। 
বান্দরবানের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও কবি আমিনুর রহমান প্রামানিক বলেন, “আদিকাল থেকে পার্বত্য এলাকায় বসবাস করা সম্প্রদায় মাচাং ঘরে বসবাস করে আসছে, তারা ঘর তৈরির কথা ভাবলেই মাচাং ঘরের কথা বলতো এবং বন জঙ্গল থেকে ভালোমানের বাঁশ ও ছন নিয়ে মাচাং ঘর তৈরি করতো কিন্তু এখন মাচাং ঘর হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে।” তিনি জানান, কালক্রমে পার্বত্য জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে পড়েছে। তাই এখন বন্যপশু বা হিংস্র প্রজাতির জীব-জন্তুও বিরল হয়ে পড়ছে। ফলে সেই হিংস্র পশুর আক্রমণের আশংকাও আর নেই। পাশাপাশি আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন প্রায়ই ঘরে দরজা ব্যবহার চলছে।
কেবল গ্রামাঞ্চলে সংস্কৃতিগত কারণে অথবা বিশেষ বাস্তবতায় এখনও ব্যবহার রয়েছে এ ঐতিহ্যবাহী মাচাংঘরের। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউটের কনভেনিং কমিটির সদস্য সিং ইয়ং বলেন, “এক সময় মাচাং ঘর পাহাড়ের জন্য জনপ্রিয় হলে ও দিন দিন এই ঘর হারিয়ে যাচ্ছে।
এখন জনসাধারণ ইট সিমেন্টের দালান তৈরি করতে ব্যস্ত। মূলত বনে বাঁশ,গাছ আর ছন নেই, তাই সাধারণ মানুষ মাচাং ঘর তৈরি করতে পারছে না আর আমরা হারিয়ে ফেলছি মাচাং ঘর।”

শেয়ার করুন