এস,এম,রকি খানসামা (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার পাকেরহাট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সাহাদাত আলী সবুজ গত কয়েক মাস ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। এতে কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক মহলে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ।
জানা গেছে, সাহাদাত আলী সবুজ পূর্বে টংগুয়া হাসনাবাগ দ্বিমুখী ফাযিল মাদ্রাসায় প্রভাষক ছিলেন। ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি পাকেরহাট কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। কলেজটি ২০১৮ সালের ২৫ আগস্ট সরকারি স্বীকৃতি পায়।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দ বণ্টন, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশাসনিক নানা কাজে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জড়িত ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে তাঁর মামা আবুল হাসান মাহমুদ আলী নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সক্রিয়ভাবে আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং পরবর্তীতে ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকুরিজীবী হয়েও তিনি একাধিক জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর বিএনপির কার্যালয়ে ভাঙচুর ও চাঁদাবাজির অভিযোগে খানসামা থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় সাহাদাত আলী সবুজ এজাহারনামীয় আসামি হন। মামলার পর থেকেই তিনি কলেজে অনুপস্থিত, তবে নিয়মিত বেতন উত্তোলনসহ গোপনে দাপ্তরিক কার্যক্রম, আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার (১২ মে) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে প্রায় ১,৫০০ শিক্ষার্থীর এই কলেজের স্বাভাবিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থী উপস্থিত হলেও ক্লাস না হওয়ায় অলস সময় কাটাচ্ছেন তাঁরা।
অনেক শিক্ষক-কর্মচারীও নিয়মিত উপস্থিত থাকছেন না। তবে এদিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকায় এইচএসসি প্রথম বর্ষের অধিকাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিতি দেখা গেছে। এইচএসসি, অনার্স ও ডিগ্রি পরীক্ষা কেন্দ্র হওয়ায় বছরের অধিকাংশ সময় পরীক্ষায় কেটে যায়। অন্য সময়েও ক্লাস না পেয়ে শিক্ষার্থীরা মাঠে অলস সময় কাটান। অধ্যক্ষের অনুপস্থিতির সুযোগে অনেক শিক্ষক-কর্মচারীও কলেজে অনিয়মিত উপস্থিত হন।
কলেজ সূত্র জানায়, ৬ সদস্যের একটি কমিটি ভর্তি, ফরম পূরণ, অভ্যন্তরীণ ও ইনকোর্স পরীক্ষা এবং শৃঙ্খলাসহ সার্বিক প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে অধ্যক্ষ না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে, জরুরি কাগজে স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কেউ কেউ গোপনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্বাক্ষর নিচ্ছেন।
শিক্ষক ও কর্মচারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়মিত কলেজে না আসায় পাঠদান ও দাপ্তরিক কার্যক্রমে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সারাক্ষণ মোবাইলে নির্দেশনা নিতে হয়। মামলার আসামি হওয়ার পর তিনি কলেজে আসছেন না। কলেজটি সরকারি করার সময় তাঁর ভূমিকা থাকায় অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পান না।”
উচ্চ মাধ্যমিক ও অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী নাইম হাসান, কামরুজ্জামান, সিদরাতুল ও লিটন ইসলাম বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকে অধ্যক্ষ স্যারকে আর কলেজে দেখিনি। ক্লাস না হওয়ায় কলেজে এসে সময় নষ্ট হয়। পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে।”
কলেজের মুভমেন্ট রেজিস্ট্রার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অধ্যক্ষ ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ৬, ১১, ২১ ও ২৫ আগস্ট এবং ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর বাইরে যাওয়ার কথা রেজিস্টারে লেখা আছে। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও অধিকাংশ দিনের অনুপস্থিতির কারণ রেজিস্টারে উল্লেখ নেই।
এক কর্মচারী বলেন, “বর্তমানে কলেজে ক্লাস কার্যক্রম প্রায় স্থবির। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কমে যাচ্ছে। এলাকার লোকজন আমাদের কাছে প্রায়ই জবাব চায়।”
বিষয়টি জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সাহাদাত আলী সবুজ মুঠোফোনে বলেন, “আমি বাইরে আছি, দাপ্তরিক কাজ তো চলমান।” এতদিন অনুপস্থিত থাকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ছুটিতে আছি।” তবে আগস্টের পর এত দীর্ঘ সময় ছুটিতে থাকার বিষয়ে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
মামলার বিষয়ে খানসামা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নজমূল হক বলেন, “অধ্যক্ষ সাহাদাত আলী সবুজ এজাহারনামীয় পলাতক আসামি। তাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) রংপুর অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক আমির আলী বলেন, “এখন কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। কলেজ পরিদর্শন ও তদন্ত করে তারপর এই বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
স্থানীয়রা বলছেন, “জনগণের করের টাকায় পরিচালিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমন অনিয়ম দুঃখজনক। দ্রুত তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”