এস.এম.রকি,খানসামা (দিনাজপুর) প্রতিনিধি: নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে ১৮৯২ সালে যাত্রা শুরু করা দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ১৯নং বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এ বছর উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামে ১৮৯২ সালে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ঐ এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবক আ: বকস হাজীর দানকৃত জমিতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠে। এই প্রতিষ্ঠান শুরুর দিকে নিরক্ষর মুক্ত এলাকা গড়তে স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় বাঁশের বেড়া ও টং-এ প্রতি সন্ধ্যায় ক্লাস নেওয়া হত। সময়ের পরিক্রমায় এটি হয়ে উঠে প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সরকারী নিয়োগ অনুযায়ী ১৯৫৮ সালে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান গৌরাঙ্গ চন্দ্র রায়। এদিকে বর্তমান প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম গত ২০০৮ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে সময়ের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষার মান, শিক্ষার্থী সংখ্যা ও স্কুলের অবকাঠামো ও আশেপাশের পরিবেশ।
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে স্কুল ক্যাম্পাসে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার পাকেরহাট থেকে বোর্ডেরহাট যাওয়ার রাস্তার পাশেই বালাপাড়া নামক স্থানে এই স্কুলের অবস্থান। পাশেই রয়েছে বালাপাড়া দাখিল মাদরাসা। মূল সড়ক দিয়ে প্রবেশ করেই দেখা যায় ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই চলছে জাতীয় সংগীত গাওয়া ও দৈনিক সমাবেশ। এরপরে একটু এগুলেই চোখে পড়বে নির্মাণাধীন ১টি ভবনসহ ৩ তলা ২ টি ভবন, শ্রেণীকক্ষ, ফুলের বাগান, খেলার মাঠ। মূল ভবনে রয়েছে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের কক্ষ, দেওয়ালে সু-সজ্জিত প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণীকক্ষ, সততা ষ্টোর, দেয়াল লিখন। তবে বিদ্যালয়ের কিছু অংশে সীমানা প্রাচীর ও মূল গেট না থাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলে প্রায় সময়ই বিপত্তি ঘটছে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ৪৩১ জন ছাত্র-ছাত্রী এ স্কুলে পড়ালেখা করছে। অপরদিকে তদারকি ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নরত আছেন ৫১ জন। এদের পাঠদানের জন্য আছেন প্রধান শিক্ষকসহ ১০জন শিক্ষক। তবে শিক্ষার্থী সংখ্যার চেয়ে শিক্ষক কম হওয়ায় পাঠদান দিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানায় ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর চেয়ে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, শিক্ষকদের স্বদিচ্ছা, পাঠদান ও সুষ্ঠুভাবে বিদ্যালয় পরিচালনার কারণে উপজেলার শ্রেষ্ঠ হয় এই প্রতিষ্ঠানটি।
তবে পরীক্ষা পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কিছুটা কমে গেছে বলে জানা যায়। এইজন্য সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি ও উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মোবাইলে মেসজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর প্রতিদিনের উপস্থিতির তথ্য অভিভাবকদের জানানো হয়। এছাড়াও নিয়মিত হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক, অভিভাবক ও মা সমাবেশ করছেন স্কুলের শিক্ষকরা।
এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম গত ২০২৩ সালে উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গবেষণা পরিষদ থেকে পুরষ্কৃত হন। এছাড়া চলতি বছর এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মোছা: মাহফুজা বানু উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
চলতি বছর ২০২৪ সালসহ বেশ কয়েকবার শিক্ষা, ক্রীড়া ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হওয়া বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গত কয়েক বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার পূর্বে ২০১৯ সাল পূর্ববর্তী সময়ে জিপিএ-৫, ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ বৃত্তিতে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মত। এছাড়াও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সৃজনশীল নানা আয়োজনে এই প্রতিষ্ঠানের সরব উপস্থিতি রয়েছে।
রবিউল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, বর্তমান সময়ে প্রাইভেট স্কুলের প্রতি আগ্রহ বাড়লেও ব্যতিক্রম এই স্কুল। এই স্কুলের শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের আগ্রহ তুলনামূলক অনেক ভালো।
খানসামা উপজেলার সেরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর প্রায় অনেক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং সহ বিভিন্ন সেরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। এই বিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থীরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ দেশ সেবায় বিভিন্ন পদে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন।
ঐ স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী ও বিসিএস (সড়ক ও জনপথ) এর ৩৭ ব্যাচের কর্মকর্তা মো: আমানউল্লাহ আমান, প্রত্যন্ত এলাকায় আমাদের এই স্কুলের অবস্থান হলেও শিক্ষকদের আন্তরিকতা আর এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় বরাবরই ফলাফল অন্যান্য স্কুলের তুলনায় ভাল হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সন্তানের মত আদর-যত্ন করে স্কুল সময়ের পরেও বিকেল হতে রাত পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ান। এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি।
বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমিত সামর্থ্য নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় শিক্ষার মানোন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছি। তারই স্বীকৃতি স্বরুপ এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। তিনি আরো বলেন, আগামীতে সবার সহায়তা পেলে এই প্রতিষ্ঠানকে আরো বেশী উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন করা সম্ভব হবে।
এবিষয়ে খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ তাজ উদ্দিন বলেন, প্রত্যেক মানুষের জীবনে পরিবার এরপরে মূল ভিত্তি হল প্রাথমিক শিক্ষা। এই প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বালাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই স্কুলের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি এবং যেকোনো প্রয়োজনে সর্বদাই উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে থাকবে।