আজম রেহমান, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : ঠাকুরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় রাকেশ রায় (১৫) নামে এক স্কুলছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সহপাঠীরা ছুটে এসে রাস্তায় তার নিথর দেহ দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা সড়ক অবরোধ করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রাকেশের মৃত্যুর প্রতিবাদে ৬ দফা দাবি নিয়ে গড়েয়া-ঠাকুরগাঁও সড়ক অবরোধ করে রাখেন সহপাঠীরা। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের আশ্বাসে রাত ১১টার দিকে তারা অবরোধ তুলে নেন।
দুপুরে স্কুল ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার পথে নসিমনের ধাক্কায় রাকেশ তার বাইসাইকেলসহ ছিটকে পড়ে যায়। সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাকেশ গড়েয়া ইউনিয়নের গোপালপুর দেউনিয়া বাজার এলাকার মৃত নিরঞ্জন রায় ও জুথী রাণী দম্পতির ছোট ছেলে। সে এস.সি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সাইফুল-রাজেন ও মিজানুর বলেন, রাকেশের মৃত্যু কর্তৃপক্ষের অবহেলার ফল। তাই আমরা স্কুলকেই দায়ী করছি। দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসছি। আমরা আর রাকেশের মতো বন্ধুকে হারাতে চাই না। প্রতিদিন ভয় নিয়ে স্কুলে আসি, সড়কে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কেউ নজরদারি করে না। রাকেশের পরিবার তাকে কত কষ্টে এতদূর এনেছিল। তার বাবা মারা গেছেন, মা দিনমজুর। সে কষ্ট করে পড়াশোনা করত। আজ সে নেই। আমরা পরীক্ষা চাই, ক্লাস চাই, কিন্তু তার আগে চাই নিরাপদ সড়ক। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সহপাঠীরা সড়ক অবরোধ করে ৬ দফা দাবি জানায়। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করা, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে রাকেশের সৎকারসহ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া, অবহেলার দায়ে স্কুলের গেটম্যানকে চাকরি থেকে বহিষ্কার ও রাকেশের পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়া, স্কুলের সামনে স্পিডব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং স্থাপন, স্কুল প্রশাসনের ক্ষমা প্রার্থনা, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বাতিল এবং চালককে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা।
রাকেশের গ্রামের বাড়িতে শোকের ছায়ায় বাকহারা পুরো পরিবার। দুই বছর আগে তার বাবা নিরঞ্জন রায় হার্টস্ট্রোকে মারা যান। এরপর থেকেই পরিবারে নেমে আসে অভাব, আর সেই অভাব পেরোনোর স্বপ্ন সবচেয়ে বেশি দেখত রাকেশ। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল মেজো। বড় ভাই পংকজ রায় গড়েয়া ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে এবং পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় ওষুধের দোকানে কাজ করে সংসারে সাহায্য করে। মা জুথী রাণী দিনমজুরের কাজ করে কোনো মতে সংসার চালান। তার একমাত্র ভরসা ছিল রাকেশ। ছেলে একদিন ভালো চাকরি করে সংসারের দুঃখ দূর করবে এই ছিল তার স্বপ্ন। আর সেই ছেলেই আজ নিথর পড়ে আছে রাস্তায়।প্রতিবেশী রমেশ, দিপু ও সুরেন বলেন, রাকেশ ছিল অত্যন্ত মেধাবী। তার মা প্রায়ই বলতেন- রাকেশই আমার শক্তি, একদিন সে আমাকে দুঃখ থেকে তুলবে। অথচ সেই ছেলেটাই আজ নেই। রাকেশের ঘর, বইয়ের ব্যাগ, পড়ার টেবিল-সব যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার মায়ের মুখে এখন ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন- আমার ভরসার ছেলেটা আর উঠবে না?
রাকেশের ভাই পংকজ রায় বলেন, আমি কলেজে পড়ি, পাশাপাশি কাজ করি। সে আমাকে প্রায়ই বলত- দাদা, একদিন আমি কিছু একটা করব, আমাদের কষ্ট শেষ হবে। আজ তাকে হারাতে হলো। মা দিনমজুরি করে আমাদের মানুষ করছেন। রাকেশ ছিল মায়ের সবচেয়ে কাছের। ওকে নিয়ে মা কত স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। আমরা কাকে বলব আমাদের এই কষ্ট? রাস্তায় বের হলেই কি মরতে হবে?মা জুথী রাণী বলেন, রাকেশ ছিল আমার একমাত্র ভরসা। বাবাকে হারানোর পর ও-ই আমাকে সাহস দিত। বলত- মা কাঁদিস না, আমি বড় হব, তোমার সব দুঃখ দূর করব। আজ সেই ছেলেটাই নেই। দিনমজুরের কাজ করে আমি কত কষ্ট করে ওদের মানুষ করছি। স্কুল থেকে ফিরে বই নিয়ে বসে থাকত। কত স্বপ্ন ছিল আমার- একদিন বড় অফিসার হবে, আমাকে আর কষ্ট করতে দেবে না। সে স্বপ্নও শেষ হয়ে গেল। সকালে তাকে স্কুলে পাঠাই, সন্ধ্যায় লাশ হয়ে ফিরে আসে। আমার ছেলের দোষই বা কী? আমি ন্যায়বিচার চাই, যেন আর কোনো মা এভাবে সন্তান হারিয়ে পথে না বসে। ঠাকুরগাঁও সদর থানা পুলিশের ওসি মো. সরোয়ারে আলম খান বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত ছিল, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছি। পরে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেয়। তিনি আরও বলেন, জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। সড়কে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক বিভাগকে নিয়ে আমরা যৌথভাবে নজরদারি বাড়াচ্ছি।