ইব্রাহীম মিঞা, বিরামপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি :বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান আদিল নিজ বাড়িতে খেলছিলেন। হঠাৎ বাড়ির দরজায় কুকুর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিতে গেলে কুকুরটি তাঁকে আক্রমণ করে বসে। তাঁর মুখে কামড় দিয়ে গালের মাংস ছিঁড়ে নেওয়ায় রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দেখা যায় জরুরি বিভাগের দরজায় লেখা এখানে র্যাবিস ভ্যাকসিন (জলাতঙ্ক রোগের টিকা) সরবরাহ নাই। পরবর্তীতে ৪ বছরের শিশু আদিলকে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করেন। আদিলের মুখে ২১টি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার। এঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরশহর এলাকায়।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) আনুমানিক বিকেল সাড়ে চারটায় বিরামপুর পৌরশহরের ৪ নং ওয়ার্ডের পূর্ব জগন্নাথপুর নতুন বাজার এলাকার হুমায়ন কবিরের বড় ছেলে আলামিন খাঁন (অপু) এর একমাত্র ছেলে আদিল আহনাফ খাঁন রিয়াদকে(৪) একটি কুকুর তাঁর নিজ বাড়িতে আক্রমণ করে মারাত্মকভাবে জখম করে।আদিল আহনাফ খাঁন রিয়াদ এর ছোট চাচা রাশেদ খান দিপু জানান, আমার বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে আদিল আমার ভাস্তা (ভাতিজা) বিকেলে বাড়িতেই খেলতেছিল। এসময় বাড়ির গলিতে একটি কুকুর প্রবেশ করে। পরবর্তীতে কুকুরটি বাহিরে আসার সময় আমাদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। খেলতে থাকা আদিল কুকুরটিকে বাহির করে দিতে গেলে কুকুরটি আদিলের উপর আক্রমণ করে বসে। কুকুরটি আদিলকে মাটিতে ফেলে মুখের উপর ৪-৫ বার কামড় দিয়ে বাম পাশের গালের মাংস ছিঁড়ে নেয়। এতে আদিল কে গুরুতর আহত অবস্থায় বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেবিট ভ্যাকসিন না থাকায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। পরবর্তীতে তাঁর মুখে ২১ টি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে জানান তাঁর চাচা রাশেদ খান দিপু।আদিল বিরামপুর চাইল্ড কেয়ার ক্যাডেট একাডেমীর প্লে শ্রেণীর ছাত্র। বর্তমানে সে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, একসময় প্রতি বছর পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে বেওয়ারিশ কুকুর মাইকিং করে মেরে ফেলা হতো। পরবর্তীতে কুকুরের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে কুকুরে গায়ে রং করে দেওয়া হতো যে,ঐ কুকুরটির কামড়ে ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি এই কার্যক্রম বন্ধ। ফলে বেওয়ারিশ কুকুর যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে এদের হিংস্র তাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত পশু পাখি এর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পশু হাসপাতালে মিলছে না র্যাবিস ভ্যাকসিন(জলাতঙ্ক রোগের টিকা)। ফলে বাহির থেকে সংগ্রহ করতে অসহায় পরিবারগুলোকে গুনতে হচ্ছে হাজার খানেক টাকা। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি সরকার কি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
প্রাণিকল্যাণ আইন-২০১৯ এর ৭-এর-২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মালিকবিহীন কোনো প্রাণী হত্যা করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে একটি সংগঠনের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কুকুর নিধনে আদালতেরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
অনেক সময় উপজেলা ও পৌরশহরে স্থানীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে মাইকিং করে বেওয়ারিশ ক্ষতিকর কুকুর মেরে ফেলা হতো। এ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বর্তমানে সমাজে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে খাদ্য অভাবে অনেক কুকুর হিংস্র হয়ে ওঠেছে। এসমস্ত কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছে গৃহপালিত পশু পাখিসহ সাধারণ মানুষ বাদ পড়ছে না শিশুরাও। সারাদেশে র্যাবিস ভ্যাকসিন সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ না থাকায় প্রতিবছর দুহাজারের বেশি মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়।
বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এর জরুরি বিভাগ ও অফিস সুত্রে জানাযায়, প্রায়ই দিনে ৬-৮ বার জরুরি সেবায় র্যাবিস ভ্যাকসিন এর খোঁজে কল আসে। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে র্যাবিস ভ্যাকসিন না থাকায় বাহিরে থেকে ক্রয় করতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। এবছর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ৫৫ জন রোগীর শরীরে কুকুর ও বিড়াল কামড়ানোয় র্যাবিস ভ্যাকসিন পুশ করা হয়েছে।
বিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, আব্দুল আউয়াল বলেন, প্রায়ই ৩-৪ জন কুকুর কামড়ে আক্রান্ত হয়ে র্যাবিস ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে আবেদন করেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করে থাকি। ২০২৩ সাল থেকে ২০২৫ সালের এপর্যন্ত ৪৭ জনকে ১১৫ টি র্যাবিস ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সহোযোগিতা করা হয়েছে।
বিরামপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বিপুল কুমার চক্রবর্তী বলেন, আমাদের কোন প্রাণিকে হত্যা করার নিয়ম নেই, আমরা প্রাণিকে বাঁচানোর জন্য কাজ করে থাকি। প্রায়ই কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত গৃহপালিত পশু চিকিৎসা সেবা নিতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে আসে।র্যাবিস ভ্যাকসিন সরকারিভাবে আমাদের কাছে সরবরাহ না থাকায় বাহির থেকে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। বাহির থেকে তারা ক্রয় করে নিয়ে আসলে আমরা সেটা প্রাণীর শরীরে পুশ করে দেয়। তিনি আরো জানান যে, গত মাসে পলিপ্রয়াগপুর ইউনিয়নে একি দিনে ১২ টি পরিবার উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে তাঁদের গৃহপালিত পশুকে কুকুর কামড়ানোর কারণে চিকিৎসা সেবা নিতে আসে ।এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ৪৫ টি গৃহপালিত পশু কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছে এর মধ্যে ছাগলের সংখ্যা বেশি।
বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুজহাত তাসনীম আওন বলেন,যদিও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাবিহীন প্রাণী হত্যা অপরাধ। এরপরও যে সমস্ত কুকুরের দ্বারা মানুষ ও গৃহপালিত পশু পাখি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এগুলোকে চিহ্নিত করে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে পরামর্শক্রমে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত ভুক্তভোগীরা র্যাবিস ভ্যাকসিন এর জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে আবেদনের মাধ্যমে সহোযোগিতা গ্রহণ করতে পারবে।